কোনো তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা কিংবা মতবাদকে (যে ঘটনা রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কিংবা সাহিত্যিক যে কোনো প্রসঙ্গেই হতে পারে) সুনির্দিষ্ট করে কালের কষ্টি পাথরে যাচাই করার প্রয়াসে কালে-কালে এই কালবিভাজন দেখা যায়।
সাহিত্যে দশকবিভাজন সম্পর্কে আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘এটা (দশকবিভাজন) একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে।
আমার মনে হয়, শূন্য দশকে রচিত কবিতার কাণ্ডারি প্রান্তিক পর্যায়ের কবিগণ। যাঁরা মিডিয়া প্রত্যাখ্যাত, যাঁরা বুঝে গেছেন, মিডিয়া মাকড়সার জালমাত্র; যেখানে আটকে গত তিন দশকে অনেক কবিই হারিছেন কবিত্ব।
পাঠকবৃন্দ, শূন্য দশকের কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে উপরিউক্ত এই আলোচনার পর শূন্য দশকের কয়েকজন কবির কবিতার সম্ভাবনা নিয়ে এখন আমরা কথা বলব। তবে এ ব্যাপারে বিনীত ভাবে বলছি, যাদের কবিতা নিয়ে কথা বলব, তারাই শূন্য দশকের শ্রেষ্ঠ কবি- এমনটি যেন কেউ মনে না করেন। এটা আমার সীমাবদ্ধতা, কারণ শূন্য দশকের সকল কবিকে নিয়ে আমি আলোচনা করতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করি এঁদের বাইরেও অনেক কবি আছেন যারা নিভৃতে নিরন্তর কবিতার প্রসঙ্গ ও আঙ্গিক পরিচর্যায় স্বতন্ত্র্য মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। যাদের কবিতা নিয়ে কথা বলব, তারা অগ্রজদের কবিতা দ্বারা কতটা প্রভাবাচ্ছন্ন; তা শুঁকে দেখার বদলে তাদের কবিতার সম্ভাবনার দিকেই আমরা ধাবিত হবো।
শূন্য দশকের কোনো কোনো কবির কবিতায় ভাবের উত্থান-পতন লক্ষণীয়। কখনো মনে হতে পারে একাধিক ভাবনাকে জোড়া তালি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে পুরো একটি কবিতা। কবিকন্ঠ কখনো ভাবের গভীরতায় উচ্চকিত কখনোবা নমিত। কবির বক্তব্য যেন এঁকে বেঁকে এগুচ্ছে আর কবিতার বক্তব্যে জড়িয়ে যাচ্ছে বহু বিচিত্র ছবি, বিবিধ অনুষঙ্গ। উপমা, প্রতীক, রূপক, চিত্রধর্মিতা ইত্যাদি সিনেমেটিক দৃশ্যের পরস্পরায় প্রকাশ পাচ্ছে। কবিতার কোনো কোনো পঙ্ক্তি হঠাৎ থিয়েটারের নাট্য-সংলাপের মতো শোনায়। আমি বলবো, কবিতার এই উৎসার মূলত একজন কবির প্রাতিস্বিকতারই প্রমাণ। কবি কাজী নাসির মামুনের ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যটি পড়ে আমার তা-ই মনে হয়েছে। যেমন-
‘তার মনে এক নেই
বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক
কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি
ঠোঁটে তার
মনের পেরেক।’
এভাবে ‘কটাশ কটাশ কাটে বাঁশ কাটা পাখি’ কবিতাটি শুরু হয়। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে এদিক-ওদিক। আবার সহসা কবি ফিরে আসেন বিন্দুতে। কবিতার বক্তব্য পুনঃপুন বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে আসে ঐক্যে। মনে হয়, তিনি যেন দক্ষ ধীবর, হাতের জাল মাঝ নদীতে ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে কিনারে টানেন। ‘কুকুরীর জন্য সংবেদনা’ কবিতায় তিনি যখন উচ্চারণ করেন-
‘আঘাতে আঘাতে মানুষ দুস্য হয়ে যায়।
চিতই পিঠার মতো জালি জালি কলিজায়
রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে তার।’
কিংবা
‘বোধিরা মরেছে আজ, কেউটেছোবল খাচ্ছি বর
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর।
নীলকণ্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?
এদিকে সেদিকে খুঁজি, চারপাশে তোমার আকার
সবঘাটে হাস খেল, মূলত এ আমিই মাকাল,
সাঁই বেহুলা যে, প্রেমের করুণা সঞ্জীবনী
একবার বীণ ধরো, সর্প এসে ফেলে যাক মনি’। (লখিন্দরের গান)
তখন আমরা শূন্যে দশকের এই কবির প্রতি আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই দীর্ঘ। তাই কবিতার ভাবগত ঐক্য আবিষ্কারে পাঠকের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কবিতায় উপমার খোপ সফলভাবে প্রয়োগের ফলে কবিতায় আসে নান্দনিকতা। কালে-কালে কবিতার এই অলঙ্কার কবিতার ভাষাকে পাঠকের মর্মমূলে পৌছে দিতে সাহায্য করেছে। আর তাই কবিতায় উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব কবির মাঝেই দেখা যায় একধরনের সহজাত আকর্ষণ। শূন্য দশকের অনেক কবির কবিতায় উপমার স্বতন্ত্র্য ব্যবহার চোখে পড়ে। কবি মোস্তফা তারেকের ‘শরিকানা চোখ’ কাব্যের কবিতা গুলোতে উপমার উৎকৃষ্ট প্রকাশ আমাদের অবাক করে। ‘উপমাই কবিত্ব’- তাঁর কবিতায় এই কবিত্ব শক্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি ঘটেছে। তাঁর নির্বাচিত উপমাগুলো স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা ও বোধের নির্যাসে উৎকীর্ণ। সংবেদনশীল মন ও মননের মেলবন্ধনে তিনি প্রবেশ করেছেন নস্টালজিক অনুভূতির পৃথিবীতে। তাঁর পায়ে চলা পথ-ঘাট, স্মৃতিময় শহর, মোহময় ব্রহ্মপুত্রের দু’তীর তাঁকে বার-বার আলোড়িত বিলোড়িত করেছে। তাঁর বলার ভঙ্গি শিশুর পবিত্র, বিশ্বস্ত উচ্চারণের মতো। কোনো ভণিতা করে নয়, লোকজ অনুষঙ্গকে তিনি উপমার মাধ্যমে কবিতায় উৎরে দেন। যেমন-
ক.
‘আমরা একদিন রক্ত জবার মতো দলা পাকিয়ে ছিলাম
আমরা একদিন জয়নুল চত্ত্বরে সেদ্ধভাতের ফেনার মতো শুভ্র ছিলাম। (শুভ্র ছিলাম)
খ.
রোদ্দুরের গোড়ালি কামড়ে সোনা সোনা কত কথা
ধান ছিল মৌ মৌ উঠোনের প্রান্তর।
গ. আম্মার শাড়ীর আচঁল যেন
কামরাঙ্গা ফুলের হাসি
... ... ...
মেয়েটির চুল যেন কালিজিরা
চালতা পাতার মতন দেহ।
মোস্তফা তারেকের ‘শরিকানা চোখ’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় তিনি যেন টোটাল ময়মনসিংহ শহরকে বেঁধে ফেলেছেন কবিতার ফ্রেমে। কাব্যের ‘এই শহর ছেড়ে যেয়োনা কোথাও’, ‘মাসকান্দা’, ‘আমার প্রতিপক্ষ ট্রেন’, ইত্যাদি কবিতা তার উজ্জ্বল উদাহরণ। যেমন-
‘পার্কের বেঞ্চগুলো এখনও আমাদের অপেক্ষায়
উন্মুখ হয়ে থাকে, উন্মুখ হয়ে থাকে
জয়নুল চত্বরের মায়াবী নিসর্গ।
.... .... ....
ব্রহ্মপুত্র আমাদের না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে
চলে যায় একা, তাই তো সমুদ্র ডুবে যায় আরো নোনা জলে’। [‘শুভ্র ছিলাম]
শূন্যদশকের কবি এহসান হাবীব তাঁর কাব্যগ্রন্থের (শাদা প্রজাপতি) প্রারম্ভে নিজেকে পাঠকের সামনে উন্মোচন করেন এভাবে:
‘একটা কাটা ঘুড়ির লেজ ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে
আমি যাকে পাই সে আসলে কেউ না। আমারই
অন্য সংস্করণ, বোধহয় কুড়িতম। ... এই সেই ঘুড়ি,
যা একদা আমিই উড়িয়েছিলাম কৈবর্ত পাড়ায়।’
তাঁর এই উন্মোচন কোনো বৈপবিক ভাষণ নয়; বরং একজন কবির আবির্ভাবকথন। শিল্পসত্তার প্রকাশ বা বিকাশ একজন শিল্পীমনের সদ্যসন্তান প্রসবা নারীর অকৃত্রিম আনন্দের মতোই বলা যেতে পারে। কারণ, দু’টি ক্ষেত্রেই শিল্পী কিংবা মা, নতুন কিছু করা বা দেওয়ার আনন্দে তুষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকেন অকৃত্রিম ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে। এহসান হাবীবের এই উচ্চারণ তাঁর শিল্পসত্তার আনন্দময় প্রকাশ। ভাটি বাংলার কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের গ্রামীণ আবহে নিজেকে তিনি নিমগ্ন করেন। স্মৃতির সিন্ধুক খুলে তিনি তাঁর কৈশোর কালকে পরখ করেন এভাবে⎯ “কৈ আর মাগুরের সাথে কিছু কৈবর্ত বালক প্রতিদিন ঘুড়ি ওড়ায় আর তার কিছু কেটে যায় সুতো।” তিনি আমাদেরকে শোনান ‘ঘুড়ির গল্প’ ‘আশ্চর্য রূপকথা, আর সন্ধান দেন ‘ঢালিয়া’ নামের এক বিলের। তাঁর কল্পনা, আবেগ আর স্মৃতিমিশ্রিত অভিজ্ঞতার নির্যাসে সৃষ্টি হয়েছে ‘শাদা প্রজাপতি’।
সর্বমোট ৪২টি কবিতা নিয়ে ২০০৯ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় কবি এহসান হাবীবের ‘শাদা প্রজাপতি’, অনেক বইয়ের ভিড়ে হয়তোবা তাঁর কাব্যগ্রন্থটি আমাদের অলক্ষ্যে রয়ে গেছে। তাতে কি, পৃথিবীতে যে কোনো কিছুর প্রথম প্রকাশ তো এভাবেই হয়, নিভৃতে, কিছুটা অগোচরে। ভাবনার নতুন বিন্যাস আর বাংলা কবিতার ঐতিহ্য-পথে কবি এহসান হাবীব তাঁর কাব্যে নতুন পথরেখা অন্বেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। কাব্যের নামকরণ রঙিন প্রজাপতি না হয়ে ‘শাদা প্রজাপতি’ হওয়ার কারণও নির্দেশিত হয়েছে কভারপৃষ্ঠার ফ্ল্যাপে। যেখানে তাঁর কবিতার বয়ন ও বয়ানের কিছুটা ইঙ্গিতও দুর্লক্ষ্য নয়। “কবিতা তো প্রজাপতিই। তবে এতকাল কেবল পাঠকের কাছে অলঙ্কারবহুল রঙিন প্রজাপতিই উপস্থাপিত হয়েছে। অলঙ্কারের জৌলুসে, রঙের বাহুল্যে-শুধু বাংলা কবিতা কেন- সমগ্র কবিতাই কি আজ হাঁপিয়ে উঠেছে? এই প্রশ্নটি যখন জর“রি হয়ে উঠছে তখনই এহসান হাবীব কবিতার বন থেকে একটি আশ্চর্য শাদা প্রজাপতি আমাদের জন্য হাজির করেছেন।”
একথা সর্বজনবিদিত যে, একটি কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই সব পাঠককে সমানভাবে উদ্দীপ্ত করে না, আপুত করে না। কোনো কবিতার কোনো কোনো পঙ্ক্তি হঠাৎ হঠাৎ হয়তো পাঠকের মনে দাগ কাটে, দেয় শিল্পোত্তীর্ণ শিল্পের অপার আনন্দ। পাঠকের অজান্তেই সেই পঙ্ক্তি মৌমাছির মতো গুঞ্জরিত হতে থাকে মনের ভেতর। তরুণ কবি এহসান হাবীবের বেশ কিছু কবিতা কিংবা পঙ্ক্তি নিঃসন্দেহে পাঠককে কবিতার স্বাদ দেবে। শুধু দুর্বোধ্য শব্দের বুনন নয়; স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদয় উৎসারিত পঙ্ক্তি তিনি আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। কবিতার কলাকৌশল খুঁজে বের করে কবিতায় শৈল্পিক সফলতা কতটুকু হলো, তা হয়তো নিক্তিতে তোলা যেতে পারে। কিন্তু কবিতায় আরোপিত কবির ভাবনা পাঠককে কিভাবে কখন ছুঁয়ে যাবে, তা স্বয়ং কবিও জানেন না। যখন কোনো দূরবর্তী দ্বীপের রহস্য, ঘোর লাগা সন্ধ্যা অথবা অবাক করা উচ্ছ্বাসের কোনো মুহূর্ত পাঠককে আলোড়িত করে, আবার কবিতার ভেতর একজন পাঠক তাঁর নিজের প্রতিরূপ আবিষ্কার করেন, তখনই তা যার যার অন্তর্গত কথা হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে সার্বজনীন। কারণ, ভালো কবিতাই মূলত লেখক ও পাঠকের সম্মীলন। যেমন-
ক.
‘রঙের বাহার সাজিয়ে রেখে রঙের মানুষ খুঁজি
রঙের মঞ্চ লুকিয়ে রেখে রঙের স্বপ্ন আঁকি।
....... ......... ..........
অষ্টপ্রহর বৃদ্ধাঙ্গুলি সকল রঙের প্রতি।’ (রঙ)
খ.
‘ফোঁটায় ফোঁটায় জহর আমি জমা করে রাখি
মরণের দাম দিয়ে কিনি সকালের হাসি।
আয়ূরেখা হাতে নেই, আছে এক প্রাচীন বাটি
বন্ধুরা আঙুলে গুনছে বয়স আর আমি সদাগর
বাটিতে ভরছি জহর; হাসি আর রাত্রির নাম করে।’ (নতুন রুবাই)।
‘হৃদয়ের কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ একজন কবির জন্য জর“রী। কবিতার সৃষ্টিমুহূর্তে মুখোমুখি থাকেন কবি স্বয়ং আর তাঁর কবিতা। কিন্তু যখন তা পাঠক সম্মুখে উপস্থাপিত হয়, তখন তিনি (কবি) থাকেন অনুপস্থিত। কল্পনা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা কবিকে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠকের কাঠগড়ায়। একজন তরুণ কবির অভিজ্ঞতা তো মূলত: তাঁর তারুণ্যকে ঘিরে। প্রেমের তীক্ষ্ণ তীরে হৃদয়ক্ষরণ, সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, অন্তর্দ্বন্দ্ব, বাহু বাড়িয়ে কাউকে, কোনো স্বপ্নকে না ছুঁতে পারার বেদনা। কবি এহসান হাবীবের বেশ কিছু কবিতাও না পাওয়ার বেদনায় নীল হয়ে আছে। পঙ্ক্তি গুলো কখনো কখনো দাঁড়িয়েছে দার্শনিক সত্যে। তেমনি একটি কবিতা ‘ডাকনাম’, যেখানে তিনি ‘আমি নই’ বলে আড়াল করেছেন তাঁর চিরন্তন দুঃখবোধকে।
‘এই যে ছুঁড়ে মারছো, সে কিন্তু আমি নই
যে তোমার পায়ের কাছে বসে থাকে নত হয়ে-
লুটিপুটি খায়, যেন কুতুবউদ্দিন আইবেকের রাজসভার কাফ্রি দাস;
হুকুমের গোলাম, যাকে যখন ইচ্ছে ছুঁড়ে মারো।
ইচ্ছে হলে কাছে ডাকো। আদর করো। পায়ের কাছে বসে থাকো।
ঘরছাড়া রাখালের দৃষ্টিপথে তাকিয়ে থাকা মোগল শাহজাদী
এত মিনতি আর কান্না যার জন্য জমা- সে কিন্তু আমি নই।
তুমি যাকে ডাকনাম ধরে ডাকো সে আমার প্রেম।’ (ডাকনাম)
এই কবিতায় কবি স্বয়ং ’কুতুবউদ্দিন আইবেকের রাজসভার কাফ্রি দাস’ কিংবা ‘মোগল শাহজাদী’র ‘ঘরছাড়া রাখাল’ এর কষ্টে নীল হয়েছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এই কষ্টবোধ তিনি সারাক্ষণ পুষে রাখতে চাননি। কারণ তিনি বুঝে গেছেন, ‘বিচ্ছিন্নতা আসলে কাছে পাওয়ার এক তীব্র আকাক্ষার নাম’, ‘হৃদগভীরে ঘাইমারা অনুভূতিগুলো’কে তাই তিনি তুড়ী মেরে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন−
‘শেষ পর্যন্ত আমি কেবল বন্ধুদেরকেই ছেড়ে এসেছি
ছেড়ে এসেছি বাবা এবং ভাই।
এমনকি আমার প্রিয়তম নারীকেও।
শেষ পর্যন্ত আমি বাড়ির শাদা প্রজাপতিটিকেও ছেড়ে এসেছি
যিশুকে যেমন ছেড়ে গিয়েছিলো মিকেল্যোঞ্জলো।’ (বিচ্ছিন্নতা আসলে কাছে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্খার নাম)
অথবা,
‘কী অক্লেশে!
চমৎকার! আনন্দময় শিকার উৎসবের দিন-
এই ছটফটানি রেখে
শিয়রে আগুন জ্বেলে
নিজেই পুরছি মুখে নিজেরই দাওয়াই’ (ঝিম ধরানো গান)
কাব্যগ্রন্থে তিনি ‘পূর্বপাঠ’ শিরোনামে তিনটি বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যেখানে অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। প্রথাকে ভাঙতে চেয়েছেন। যারা ‘গালফোলা নাকে চশমা ঝুলিয়ে কৃত্রিম টাকের বাহার দেখিয়ে অথবা যারা হুজুর মার্কা চেহারায় নিক্তি নিয়ে আসেন (কবিতার পঙ্ক্তিকে ফিতা দিয়ে পরিমাপ করতে) তাদের জন্য পাহাড়ে ওঠা বারণ। আকাশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ।’ (পূর্বপাঠ)
কিংবা দ্বিতীয় ‘পূর্বপাঠ’ এ তিনি উচ্চারণ করেন, ‘.... তাহারা বুঝে না হায়, অতিবড় বিদ্যার জাহাজ।’ তৃতীয় ‘পূর্বপাঠ’ এ তিনি যেন আরো বেশি একরেখা, যেন একটু শাসিয়েই বলে ওঠেন− ‘কথা যারা চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, আর কবিতায় উগলায়− এ পাঠ সতর্কীকরণ। শ্বাসেরও নিয়ম আছে। নিঃশ্বাসে প্রবাহিত বাতাসের নিয়ম। এই সাধারণ লিখা কিছু কথা শোনার আগে জানা যাক− তুমি বাতাসের ভাষা কতটুকু শুনতে পাও, বীরবর।’ এক্ষেত্রে এহসান হাবীব যেন জীবনানন্দ দাশ এবং শামসুর রাহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন-
‘বরং নিজেই তুমি লেখ নাকো একটি কবিতা
বলিলাম ম্লান হেসে− ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর;
..... ...... .......
অধ্যাপক দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে− আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সবকবিদের মাংস কৃমি খুঁটি; (জীবননান্দ দাশ, সমাজ, সাতটি তারার তিমির)
‘আমার সেই নির্মাণে মাননীয়, পক্ককেশ পন্ডিত
হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রিক পুরাণের উলেখ,
দেশী কিংবা বিদেশী কবির প্রভাব শুঁকে বেড়ান তাঁরা
নিপুণ গোয়েন্দার মতো, আর না-চাইতে বিলিয়ে দেন
ঝুড়ি ঝুড়ি মূল্যবাণ কথা,
হায়রে মূল্যবান কথা!’ (শামসুর রহমান; ‘কাব্যতত্ত্ব’, ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)
‘শাদা প্রজাপতি’ কাব্যে এহসান হাবীব ‘অন্ধকার’ প্রসঙ্গটিকে বেশ কিছু কবিতায় ভিন্ন-ভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করেছেন। তবে, তাঁর প্রয়োগকৃত অন্ধকার প্রসঙ্গটি একটি দার্শনিক ঐকসূত্রে স্থাপিত হয়েছে। বাংলা কবিতায় ‘অন্ধকার’ প্রসঙ্গটির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। কবি কায়কোবাদ তাঁর ‘নিবেদন’ শিরোনামের একটি কবিতায় লিখেছেন−
‘আঁধারে এসেছি আমি আঁধারেই যেতে চাই
তোরা কেন পিছু পিছু আমারে ডাকিস ভাই?’
কায়কোবাদ এখানে জন্ম ও মৃত্যুর পূর্বাবস্থাকে অন্ধকার বলে একটি ধ্রুব দার্শনিক সত্যে দাঁড় করিয়েছেন। বস্তুত ‘অন্ধকারভীতি’ কিংবা ‘অন্ধকারপ্রীতি’ শিল্পী মানসকে আন্দোলিত করেছে ভীতি, সংশয় এবং এক চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে। তরুণ কবি এহসান হাবীব ‘অন্ধকার’ কে প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকটা কায়কোবাদের দার্শনিক সত্যের অনুরূপ। বোধকরি তিনিও অন্ধকারকে অস্বীকার করতে পারেননি। অন্ধকার ভালোবেসে তিনিও যেন অন্ধকারে লুকাতে চান আপনমুখ। তিনি অকপটে বলেছেন− ‘গুহার প্রত্ন আঁধার আমার প্রধানতম আশ্রয়’।
‘মোমটা খুঁজে পাচ্ছি না, আলোটা-
অথচ অন্ধকার একদম স্পষ্ট সহায়কহীন
আলো তো নকল, মেকী− চতুর্ভূজের ভীড়
আর প্রকৃত কথার মতো অন্ধকারই মৌলিক
অন্ধকারে দেখে না কেউ।
... ... .... ....
অন্ধকার ভালোবেসে সাধু বসে আছি
হাতড়ালে আমি ছুঁতে পারি পৃথিবীর মুখ।’ (‘অন্ধকার-১’)
কিংবা,
‘ছিলাম তো অন্ধকার বারান্দায়,
তীব্র আলোক দহন−
মাগো, পুড়ালো তাবৎ কোমল
তার লাগি ঠেলেছি এই আলোক অধ্যাস।
..... .... .....
আলো তো রঙের বাহার; মুখোশের কারসাজি,
নিয়েছি নকলের অমিত প্ররোচনা.....।’ (অন্ধকার-৩)
তরুণ কবি এহসান হাবীবের ‘শাদা প্রজাপতি’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তাঁর অভিষেককে আমরা অভিনন্দন জানাই। আশা করি তিনি লিখে যাবেন আরো সুন্দর-সুন্দর কবিতা। যদিও একজন কবি কারও বাহবা কিংবা প্রশংসার প্রত্যাশায় বসে থাকেন না, তিনি কবি, তিনি লিখে যাবেন তাঁর ইচ্ছে মতো।
إرسال تعليق