আলতানু,
তোমারে পাইলাম না। এ জীবন রাখিয়া আর কি করিব?
সুখে থাকিও।
ইতি
ভালোবাসা
অতঃপর, ‘এ জীবন রাখিয়া আর কি করিব?’র সমাধান হল বলে, আমরা মর্গের দিকে হেঁটে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে বীভৎস হয়ে ওঠা লাশের মিছিল ঠেঙিয়ে তাকে যখন খুঁজে না পাই তখন হঠাৎ মনে পড়ে আন্ধির বাগানের কোন গাছে কি সে লটকে আছে বাদুরের মতন? তাই খুঁজতে খুঁজতে তছনছ করে সব অন্ধকার দেখা গেল মাছিদের উল্লাসে তার বিপন্ন ঘুমন্ত মুখ এক পরাজিত সেনাপতির ইতিহাস হয়ে পেন্ডুলামের মতো দুলছে নির্দোষ আম গাছের সবল বাহুতে! ফলে, আলতানু আমরা কি জানি আমাদের কি দোষ আমাদেরকে এমন ঝুলিয়ে দেয়? তুমি কি জানো তোমার মাধুর্য কেন এই মৃত্যুকে অপরিহার্য করে তুলেছিল? তুমি কি কবিতার মতো এক ঘনঘোর গুপ্ত দুনিয়া? জানা যাবে কফিনের পেরেক খুল্লেই লাফিয়ে বেরিয়ে আসা উৎকট গন্ধের থেকে একদিন জীবনের অপার সৌন্দর্যকে অসহ্য মনে হল বলে, গার্হস্থ্য সমাজ সময় কাজ সব ফেলে নিজেকে অমোঘ সেই সত্যের জন্য স্বাস্থ্যবান করে তুলতে তুলতে লিখে ফেলা সুইসাইড নোট,
ফ্লোরা,
ভালোবাসা নিও সোনা! আগামীকাল থেকে আমাদের আর দেখা হচ্ছে না! তবে আমাদের এই একসঙ্গে বেঁচে থাকার দিনের আনন্দ বেদনার গান আমি গাইতে গাইতে বলতে চাই, তুমি কখনো কোন দুঃখ দাওনি আমাকে! তবু একটা প্রত্যাখ্যান করতে না পারা টানের জন্য আমি যাচ্ছি! তবে এটা বলে যাই, নিজেদেরকে তোমরা দোষী মনে করবে না, বরং আমাকে একটা সুন্দর জীবন তোমরা দিয়েছিলে! আমার স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য তোমরা কেউ দায়ি নও! বেঁচে থাকাটার সব তৃষ্ণা মিটে গেছে। বরং আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম যেই মুহূর্তের জন্য এবার সেটাকে জাপটে ধরার পালা। বাচ্চাদের যত্ন নিও।
ইতি,
ম্যানুয়েল।
তারপর হৃদয়ে ক্রুশবিদ্ধ ফ্লোরা লিখেছিল,
জেসাস,
যে জীবন আমাকে তুমি দিয়েছিলে তার মধ্যে এতো সুধা ছিল তা আচানক কোন অপরাধে ছিন্নভিন্ন করে নিলে? পুনরুত্থান কি সত্যিই আছে? তবে ফিরিয়ে দাও তাকে? আচ্ছা আমি সব ক্ষমা করে দিয়ে চলে যাচ্ছি! আমার বাচ্চা গুলোকে তুমি দেখবে এবার! আমি তাকে ধরে জানতে চাই কেন সে আমাকে ফেলে মৃত্যুকে ভালোবাসলো!
ক্ষমা কোরো প্রভু,
তোমার সন্তান।
ফলে, পান দোকানে দাড়িয়ে দোকানীকে যখন বলি, খয়ের-জর্দা-কাঁচা-ভিজাপাতি! এবং জাদুকরের মত একজোড়া হাত দ্রুত পানের মধ্যে এইসব উপাদান দিতে ব্যস্ত হয়; তখন কাঁধের কার্নিশ ঘেঁসে কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে, ‘আরেকটু জর্দা দেয়া যায়?’ ফলে তারদিকে ঈষৎ তেরচা তাকিয়ে মুখের মধ্যে পান দিতে দিতে তার চোখে চোখ রেখে চিবুই যখন! তখন আচমকা সে আমাকে জিজ্ঞাস করে, ‘ আপ্নেও আমার মতন?’ আমি পিক ফেলে ঠোঁট মুছে তাকাই কেবল! হয়ত সে বুঝে নেয় একই ভ্রমণের যাত্রী! ফলে সে কানের কাছে মুখ এনে জর্দা গন্ধি শব্দে শব্দে বলে, ‘একটা সুন্দর মতো পাঁচতালা খুঁজতেছি! খুঁইজা পাইলেই ছাদে উইঠা পরবো! তারপর পাখি...!’ ফলে পাখি হতে চাওয়া এই লোক অনেকদিন আমার মাথার মধ্যে কিংবা আমার ছায়ার মধ্যে হেঁটে বেড়ায়! আর ক্রমশ রমণীয় হয়ে ওঠা আমাদের এই শহরের শরীর জুড়ে মেদের মতো রোজ জন্মানো সুউচ্চ দালান দেখে দেখে ভাবি এর মধ্যে পাঁচতালার অভাবটা নিগুম আছে বলেই খুঁজে পেতে একটু দেরি হয়! তবে তাকে পাওয়া যায় একদিন এক সন্ধ্যায় যখন গলি দিয়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে শোনা যায় এবাড়ি-সেবাড়ির বালক-বালিকারা গলা সাধছে যখন, ঠিক তখন হারমুনিয়ামের ক্রন্দন ছাপিয়ে কে যেন ধপ্ করে জমিনের বুকে আশ্রয় খুঁজে নিতে আসমান থেকে নাজেল হয়! জানা যাবে, লোকটা পাখি হতে চেয়েছিল! ফলে খানদান তালাস করে একটাও পাগল পাওয়া গেল না বলে, লোকটাকে পাগলা কিসিমের বলা যাচ্ছে না দেখে পাগলা কিসিমের বলে চালান দিয়ে দেয়া হল সুরৎহাল ব্যতীত এক চমৎকার গুহার ভেতরে! আর তার প্রাক পুরানিক বন্ধুরা জানাল, নরকে সে নৃত্য করবে শ্রীদেবীর সঙ্গে নির্ঘাত! ফলে প্যাথেড্রিনের ভাঙা এম্পলে ঠোঁট রেখে কে যেন শিস দিতে দিতে বলে গেল, ‘ফেরার রাস্তা আর নাই... ঝাঁপ দিয়া পড় মওলা মানুষের দরিয়ায়!’ তাকে আন্ধার থেকে টেনে বের করে সোডিয়ামের আলোর মধ্যে থ্যাঁতলান ব্যাঙের মতন চিৎ করে ফেলে দেখা যায়, লোকটার মুখে চোখ নেই ঠোঁটে আছে পাখির শিস আর দাঁত গুলো হিরে দিয়ে বাঁধানো আঙুর! তখন জীবনকে করুন মনে হয় এই মহান শিল্পীর মুখোমুখি ঝুঁকে! মজমার ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন মোলায়েম স্বরে বলে উঠলো, ‘একটু মাটি পেলে ঠোঁটটা গড়ে দেয়া যেতো, আর দুটো চোখ!’ ফলে পাল বাড়ির মেয়েটা যেদিন কীটনাশক খেয়ে মারা গেলো! মামলার ভয়ে সবাই যখন জানালো মেয়েটা ভালো ছিল না! ধরা পড়ে যাওয়ায় সে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে! ফলে এইসব কল্লোলের ভাঁজে তার স্বামী নামক বোবা লোকটা জানতো যে, বউটার খুব বাড়ির কথা মনে পড়ত, ডালিম গাছে বল্লার চাক হলে সেটা ভেঙে মাছ ধরতে যাবার গল্প শতবার সে বলেছে গেলো তিন বছরে! কিন্তু বাচ্চাটা পেটের মধ্যেই মরে যাবার পর কেন জানি, গাভি পালনের দিকে ঝুঁকে গেলো তার সব গল্পরা, তারপর সেদিন রাত্রে সে সেই গাভীর দুধের মধ্যে কীটনাশক মিশিয়ে নিজেই নিজেকে মুক্ত করে দিলো! অথচ তার আগের রাতে ঘুমের আগে অনেক্ষন বসে পায়ে আলতা দেয়ার পর যখন সে তার ভরা শরীরটাকে নামিয়ে এনেছিল বিছানায় সেই সৌরভে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল কুঁকড়ে আসা চাদরের প্রতিটা বাঁক! ফলে এই বাড়ির কথা মনে পড়ার বেদনা নিয়ে চলে যাওয়া কিংবা রেখে যাওয়া বেদনার ভার নিয়ে স্বামী নামক প্রাণীটি এবার পুজোয় দুর্গা প্রতিমা বানাবার সময় টের পেল মুখের আদলে একটা গোপন মেয়ের মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে! ফলে সেই রাতে একটা পরিপূর্ণ বউয়ের মুখ বানিয়ে সেটা নিয়ে সে নেমে গেলো ঘুঙ্গুরের জলে! লাশ যেদিন পাওয়া যায় সেদিন দেখা যায় তার শক্ত হয়ে যাওয়া হাতের ভঙ্গিমার স্পষ্ট যে, কিছু একটা সে যত্নে আগলে ছিল! যেটা এখন গলে জলে জল হয়ে গেছে!
ফলে, হে আরাধ্য মৃত্যু তোমাকে এড়াতে পারি না বলেই যত্নে বুকের মধ্যে পেলেপুষে বড় করি! যেই টান বুকের মধ্যে টের পাই, যেই অসহ্য যন্ত্রণা মাথার মধ্যে ঘুরে চলে তাকে পায়ে ঠেলে দেবার সাহস আমার নেই! তাকে আমি চাই না হারাতে! বরং প্রতিদিন ক্লান্তিকর এই বেঁচে থাকা সাজাতে সাজাতে আমি এগিয়ে যাই আমার ব্যক্তিগত মোক্ষে! স্বেচ্ছামৃত্যুর অলিন্দের দিকে! যার গ্রিল টপকালে কেউ পাখি হয়ে যায়, কেউ মুক্ত হয়ে যায় কিংবা নিজস্ব স্বাধীনতা খুঁজে পায়; যার কোন দেয়াল নেই, কাঁটাতার নেই, রাজা রাষ্ট্র, বউ-বর- সন্তান, মন্ত্রী, পুলিশ, আদালত নেই! আটকে দেবার মতন কোন হাত নেই! কেবল আছে নিজের শিহরণের মধ্যে ক্রমে ডুবে যাবার অনুভব! যেই সামান্য অনুভবকে বিব্রত করতে সমগ্র বেঁচে থাকাই যথেষ্ট! ফলে আমার মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্য এই জন্মের যেমন দরকার ছিল ঠিক একই তীব্রতায় সেটাকে নিজ হাতে ফুরিয়ে/ উড়িয়ে/ গুড়োগুড়ো করে দেবার প্রয়োজন ছিল বলেই একদিন ট্রাম লাইন ভালো লাগে কিংবা কেউ কেউ আছে রেললাইন ধরে পাথর গুনতে গুনতে নিরুদ্দেশের রাস্তার সন্ধান করে! তাই বেঘোরে সবাই যায় না কেউ কেউ যায় তবে তার মধ্যে একদল যায় সচেতন ভাবে, তাদের নাম পুলিশের বাপের সাধ্য নেই মামলায় লটকে আটকে রাখবে গারদের মধ্যে! কেননা তারা এমন এক স্বাধীন মৃত্যুর মধ্যে নিজেদেরকে ডুবিয়ে দেয় যেখানে নৈরাষ্ট্রের উচ্চতর এক ভাবনার বাসস্থান! ফলে একটি চিরকুট পাওয়া যায়...
সুদর্শন,
তোমাকে পাবার পর অনুভব হয় আজ না পেলেই ভালো হতো! তোমার গায়ের গন্ধ বেঁচে থাকতে বলে আরো! অনুভব করি আমি যেখানে বেঁচে থাকি সেটা নষ্ট হয় এতে! আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়াই জরুরী! তোমার কোন অপরাধ নেই! আমি নিজেই নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি।
- লতা।
এলএসডির স্রোতের মধ্যে সাঁতার দিতে দিতে একদিন সন্ধ্যায় একজন যুবকের বুকের উপরে উঠে আসে একটা ঝিনুক! ফলে সেই যুবক মুক্তোর খোঁজে নেমে যায় আরো গভীর গোপন গহ্বরে! যেখানে একজন ডোম বাংলা মদের বোতলে মুখ লাগিয়ে বলে ওঠে, ‘বাবু তুই ফিরে যা লছমীর আজ শরীর খারাপ! তুঁ তো ভদ্দর নোক... এখেনে কেন আছিস?’ কিন্তু লছমির জন্য বুক পোড়ে! তার শরীর দেখলে মনে হয় কোন এক ভাস্কর তার সমগ্র বেদনা ঢেলে এই মাধুরী রচনা করেছেন! ফলে লছমির নাঙ হয়ে বাঁচার মোক্ষ নিয়ে একদিন অনুভব হয় ওর ভ্যাড়া বড়টাকে খুন করে লছমীকে ছিনতাই করা যাক! কিন্তু হত্যার পর জানা যায়, লছমী ওই ভ্যাড়াটাকেই ভালোবাসতো! মন তো শরীরের দাসত্ব মানে না সব সময়! ফলে হেরে যাওয়া যুবক লছমীকে বিসর্জন দিয়ে ফিরে এসে টের পায় ভীষণ হালকা এক পালকের অনুরণন! তাই অস্বীকার করা গেলেও সবাই কি জানে সেই অনুভুতি যে অনুভুতি মাথার ভেতর জল কেটে কেটে এগোয় গোপনে! তাকে এড়াবার দ্বিতীয় উপায় থাকে না বলে, সেই সংসারে সবাইকে জায়গা দেয়া যায় না! তাই এক তীব্র তীক্ষ্ণ একাকীত্বের আসবাবে সাজানো ঘরের মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে একদিন সাহসী হয়ে উঠতেই হয়! তারপর অনেক গল্প আর ক্রন্দন ফুরালে পড়শিরা জানতে পায়, কেউ কেউ গোপনে নিজেই নিজেকে রক্তাক্ত করে স্ট্রেচারে তুলে দেয় মর্গের যাত্রী হতে! তাদের সঙ্গে অন্যদের মেলানো যাবে না! তবে সেই থোকা থোকা রক্ত জবার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমরা শুনতে পাবো, লোকটা কবি ছিল; তাই নিজেকে নিজের হাতে খুন হতে দিলো নির্দ্বিধায়!?
إرسال تعليق