১
ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড়াতেই মনে পরে গেল আমার শেষ প্রেমিকার লাল ওষ্ঠধর। যার অমল দেহ হতে চন্দ্রের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিল। শেষ রাতের প্রথম প্রহরে তার উপুড় করা পিঠ, যেটা ছিল ধনুকের মত বাঁকা, আমি স্পর্শ করবার আগেই টেনে নিয়ে এলো ওরা। ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড়াতেই মনে পরে গেল, নিরাপদ সঙ্গম ছিল না সেটা। দোকান বন্ধ হয়েছিল কারফিউ শুরু হতেই। অথচ প্রথম গুলির আগেই সন্তানের অনিন্দ্য নামটা মুখে এসে গেল। ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড়াতেই...
২
আমরা তাহাদের প্রস্থানে অশ্রু বর্ষণ থেকে বিরত হই, আমরা তাহাদের প্রস্থানে প্রতিবার হাততালি প্রদান করতে পারি, তারা চলেছেন চিরস্মরণীয় ঘুমে। আর ঘুম মাত্রই একটি সরল মৃত্যু। আমরা কফিন বহন করিবার সময় আনন্দ সংগীত গাইবো,কেননা তারা মুক্তিপত্রে নিজেদের নাম শেষবার মুদ্রন করেছেন ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে।আমরা তাহাদের প্রস্থানে একটি রোমান্টিক কবিতা রচনা করতে পারি। আর রঙিন বস্ত্রাদি পরিধান করে ছুটির দিনে তাদের দেখে আসতে পারি, এবং অবশ্যই এপিটাফে তাদের উজ্বল সহাস্যমুখের ছবি খোদিত থাকবে।
৩
উল্টো চাঁদ পড়ে আছে ডাগর গাঙ চোখে
থৈ থৈ জল ভাসায়ে নিয়ে যায় তারে
শতাব্দী আড়ষ্ট অজান বৃক্ষের তলে
আমার বাস্তু পুড়ে যায় ঝকঝকা জ্বরে,
ক্যামন, কামনার বাতি জ্বলে পূরবীর ঘরে!
বাউলা দুয়ারীর খোলসে ঝিঁঝিঁ পোকার ফাঁক গলে
গরম শিশিরে বুক ভিজে যায় তাহাদের গোঙানির সুরে
আসমান বেহায়া কতক রক্তবাদুর ঝুলে গ্যাছে ডালে
খরখরে করতলে তামাশার জোছনা গলে পরে,
ক্যামন, সৌন্দর্যের রঙ চড়ে পূরবীর ছৈ ছৈ বুকে!
তামাকের ঘর এহন বুক্কের ভেতর গলে
কাষ্ঠ ডালে কতো রঙ আগুনের গগণে
সারা দ্যাশ ছাই হয়ে আমারে রোজ রাতে
উড়ায়ে নিয়া যায় পূরবীর তুলসী তলে
দেবতারে মানি নাই পূজার ফুল রাখি নাই
অমল পাথরের বুকে মাথা ঝুকি নাই আগে
মাগো, বাস্তু আমার পুঁড়ে যায় ঝকঝকা জ্বরে।
৪
রাতগুলো সামান্য ছোট লাগে মোহগ্রস্থ জোনাকি
আমি তো বিকালের শেষ রোদগুলো গুনতে থাকি
আঙুলের ফাঁকে নির্বাক হাওয়া পাঁচ দিকে ভাসতে
থাকে জুতোর কালো ফিতা ক্লান্তি টেনে হাই তুলতে
তুলতে ভুলে যাচ্ছে রেল লাইন অনেকদূর শুয়ে আছে কেউ চিনতে পারে না ছলছলাৎ চোখের গহীনে নৌকা ডুবে যাবার চালচিত্র রিকশার বেপরোয়া আচরন পুরাতন কলারের জামার ভেতর থেকে টান মারতে চাই স্কুল ব্যাগে গল্প জমানো ইরেজারের টানে ঝাপসা মুখগুলোতে খসে পড়া বাড়ির ইতিহাস
রোজ কি আমাকেই মরতে হয় সকালের আয়নায়? দূরে কোথাও হয়তো নদীর অতলে একটি আঙুল তুলে নিশ্বাস নিতে চাইছে ব্যাকরণ ছাড়া একবার ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম এভাবে শৈশব কাটানো যায় না ম্যাডাম!
সকাল নটা মানে ব্যাকরণ ভর্তি ক্লাসে একা একা মুখস্থ করতে থাকা এভাবে জীবন কেটে কেটে পকেট ভর্তি অর্থ আমাকে পরাজিত করছে বুকের ভেতরে শালুকের কাছে জল প্রেমিকার বুকে তিল সব জেনেও আমি তো ইস্ত্রি করা জামার আস্তিন গুটাতে পারি না ছটা বেজে উঠবার পূর্বে মুঠো ভরে ভাত নিতে গেলে গুঁড়ো গুঁড়ো স্বপ্নের কর্কশ স্বাদ ছিলে দেয় জিহবার উপরিতল করাতের মত ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে
কিম্ভুত গাড়ি আর শুনশান জীবন বোধহীন কিছু ব্যাংক নোট বাজারি টাইয়ের শক্ত নক লাল নীল হলুদ ঔষধের প্যাকেটের উপর নারীদের নগ্নতা শহরের উদর উল্টানো বোকা সব ডাস্টবিন
আমার জন্মানোর ভেতর দিয়ে গোপন পরিহাস প্রিয় একটা লাল হৃদপিণ্ড রক্ত বিপণন করতে করতে পৌঁছে যাবে পঞ্চান্ন বা সত্তুরে অথচ যার জন্মের আগেই মরবার স্লোগান শোনানো হয়েছিল।
৫
সিনেমার টিকিট আঙুলের ফাঁকে ধরে
এই জীবনটাকে চোখ দিয়ে
দেখছি এক বোকা দর্শক হয়ে
কখনো হাততালি, কখনো শীষবাজি
কখনো চোখ মোছার মত কারসাজি চলছে
উত্তেজনা বশত মুঠোর ভেতর ঘেমে চলেছে হাত
কাঁপছে পর্দা, ভারী ঈষৎ ময়লা যেন আমারই
জলছাপ লেগে আছে ওখানে, কেউ থুতু ফেলছে
বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এসেছে কতজনে, বাদামের খোসার
উপর মানুষের অভদ্র আচরণে কড়কড় শব্দ জন্মায়
সিনেমার টিকিট নিয়ে পান চিবুচ্ছে চিবুকের কাছে
নামহীন এক ছায়া
ক্রমাগত রিল কেটে যাচ্ছে অদ্ভুত আঁধারে
এক একটি সিগারেটের নিঃশব্দে নিখোঁজ হওয়ার
খবর না রাখা পুলিশ দরজার ফাঁক দিয়ে গুনছে
গোপন প্রনয়কারীদের আর উঠানামা করছে সদ্য
কিশোরীর নতুন বুক অশ্লীল সংগীতের তালে তালে
শেষ দৃশ্যের ভেতর আমি ছিলাম না কখনোই
পেছন ফিরে তাকিয়েছি যতবার কেঁপেছে আলো
ততবার
আঙুলের ফাঁকে ধরা টিকিটের উপর লেখা সিট
নম্বরে সব সময় উজ্বল মৃত্যু বসে থাকে, অপেক্ষায়!
৬
একটি অশ্রু ফোঁটা
টাইম ডাইলেশনে ঢুকে পড়েছি এইমাত্র
শুকিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকটি সময়ের কাটা
তোমার ঠোঁট থেকে ঠোঁট ফিরিয়ে আনবার
সময় মধ্যপ্রাচ্যে দেওলিয়া হয়ে যাচ্ছে নীল
চোখের মিষ্টি কোন রাষ্ট্রপতি
জানতাম না প্রতিটি চুম্বনের সময় তোমার চোখ
থেকে উৎপন্ন হয় দুটি অথবা তিনটি জলের ফোঁটা
টাইম ডাইলেশনের ভেতর একদিন মৃত্যু দেখতে
চেয়ে এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পাপ করতে
হয়েছে যৌবন ঘনিষ্ট কোন মধ্য বিছানায় একা...
মূলত অন্য নারীর সাথে সঙ্গম করার পর নিজেকে
খুব একাই লাগে কেননা নগ্নতা বেশী সময় উপভোগ
করা যায় না প্রিয়তমা
ঠোঁট থেকে ঠোঁট উঠে গেলে অস্থিরতা বাড়ে
আমাদের প্রতিটি চুম্বন আঁটকে যাক অগম্য
টাইম ডাইলেশনে অথবা অবধারিত অশ্রু দানায়
ডুবে যাক সাঁতারহীন এই নীল মাছি জীবন|
৭
লাশকাটা ঘরে পোস্টমর্টেম হবার পর
মাতাল ডোম ভুল করে ভুলে গেলেন
সেলাই কাটতে, খোলা দরজা পেয়ে
ডোমের পিছু পিছু গড়াতে শুরু করলো সুতো।
হাসপাতাল গেট, চায়ের দোকান, গলির মোড়
পেড়িয়ে সেই সুতোর লাটিম চলে এলো বাড়িতে,
ঘুমন্ত মা আমার, হাতের উপর হাত ফেলে ঘুমায় এখনো।
সুতো নিঃশব্দে, নির্ভুলে আটকে গেল
তার পায়ের প্রথম আঙুলে।
.
এক গোছা সুতোর জন্য ভালবাসা।
বেওয়ারিশ লাশ হতে হতে বেঁচে গেলাম।
৮
ঘুমের সাথে টুকটাক কথা"
*
: ঠক্ ঠক্
: কে?
: ভাইজান আমি ঘুম, আসতে পারি?
: কয়টা বাজে?
: মনে হয় রাত দেড় ঘটিকা!
: আরো কিছুসময় পরে আসো।
: আর তো পারছি না, কখন থেকে অপেক্ষা করছি বাইরে।
: ব্যস্ত আছি দেখ না।
: সমস্যা নেই, আমি খাটের কোনায় বসে থাকি। কোন কথা বলবো না। আপনি আপন মনে কর্ম সাধন করুন।
: বেশী কথা বল। বাইরে থেকে কয়েকটা চক্কর মেরে আসো।
: এতো রাতে বাইরে গেলে পুলিশে ধরতে পারে। বলা তো যায় না কান ধরে উঠক-বসক ও করাতে পারে। ইজ্জতের মামলা।
: এতো কথা বল কেন, জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকো। কোন কথা না, চুপ।
: জি আচ্ছা, আপনার বিবেচনা ভাল। জানালার পাশে চন্দ্র দর্শন করা উত্তম কাজ। আপনি লেখেন। কি লেখেন জনাব?
: আবার কথা, চুপ!
: দূঃখিত। জবান বন্ধ।
: তুমি আসার পর থেকে চোখ জ্বালা করছে। ঘটনা কি?
: ঘটনা তেমন গুরুত্বর না জনাব। আপনার চক্ষুদ্বয় আমাকে মিসকল দিচ্ছে।
: চুপ, ফাজিল।
: জনাব ফাজিল মানে কি আপনার কি জানা আছে?
: না নেই। জানার দরকার নেই। অতিরিক্ত কথা বললে চোখে জল মেরে ভাগিয়ে দেব।
: জনাবের কি মেজাজ খারাপ?
: হুম।
: আমাকে বললে মেজাজ ঠিক হতেও পারে।
: তোমাকে বলা যাবে না।
: আমি কি চলে যাবো?
: নাহ্ থাক। কথা বলার লোক নেই। তুমি আগেভাগে এসে ভালই করেছ। সরি!
: সরি কেন?
: খারাপ ব্যবহার করার জন্য।
: আমি আর কতসময় দাড়িয়ে থাকব?
: বিছানায় বস।
: ধন্যবাদ।
: কি লেখেন জনাব?
: সুইসাইড নোট।
: আচ্ছা। কতদূর লেখা হল?
: এগুচ্ছে না। ভাল শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
: ও, মে আই হেল্প?
: হুম পারো। এটা শেষ করা জরুরী।
: যার সাথে শত্রুতা আছে তার নাম লিখে ফাঁসিয়ে দিন। হা হা হা...
: কথা টা মন্দ বল নি। আমার আবার শত্রু মিত্র কিছুই নেই। হা হা হা...
: চিন্তায় ফেললেন জনাব।
: হুম
: তাহলে আজ থাকুক। আগামীকাল ট্রাই করেন। কাল না হয় একটু লেট করে আসলাম।
: কথা মনে ধরেছে। আর আমাগীকাল বাংলা একাডেমির বাংলা টু বাংলা ডিকশনারি কেনা লাগবে। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। শেষ নোট বলে কথা। একটা দিন না হয় বেশী লাগলো।
: অতি উত্তম বিবেচনা জনাব। আমারো ঘুম পাচ্ছে। ঢুকে যাই চোখের ভেতর?
: যাও।
: শুভ রাত্রি।
: শুভ রাত্রি।
৯
অক্টোবর আসলেই আত্মহত্যার ফেরেশতারা
কথা কইতে শুরু করে, ফিসফিসানি বাইড়া যায়।
এগারোটা মাস কি দুর্দান্ত ক্যাইটা যায় তরুণ বর্শার ফলার মতো
মসৃণ গালে নাপিতের ভীত ক্ষুরের মিহি আরামে।
গেরেস্থ বাড়ির লোকেরা সদ্য হওয়া মেম্বরের দৃষ্টিতে তাকায়ে থাকে।
আঁধার পথের দিকে ভরপুর উৎকন্ঠা নিয়া,
এসব উৎকন্ঠা অবশ্য অনেক আগেই গেছে গা। এই যে প্রতিবছর আত্মহত্যা না করে চলে আসি নিভু নিভু সংসারে, এইটা সয়ে গেছে দর্শকের।
সাহস নাই আমার!
একটা সময় টিটকারির আনন্দময় আওয়াজ শুনতে
শুনতে তাকিয়ে থাকতাম একলা টিকটিকির পানে অসুখের দৃষ্টিতে।
মাকে সন্ধ্যার নামাজের পর কাঁদতে দেইখ্যা
আমিও কাদছি ঢের তবু অক্টোবর আসলে মইরা
যাইতে ইচ্ছে করে, বাল!
কেন মরবো, কিসের এতো দুঃখ আমার;
জনে জনে জিগ্যেস করে সূর্যের টর্চ ফেলে।
মায়ে একবার নতুন বছরের ক্যালেন্ডার থিকা
অক্টোবর মাস ছিঁড়া ফেলছিল। ক্যালেন্ডারে ওই
বছর একখান সুন্দর মসজিদ কম আছিল।
বাটপার; অক্টোবর যায় নাই ভেতর থিকা।
আমারে অক্টোবরে জন্ম দিয়া জগতের সবচেয়ে
অলঙ্ঘনীয় পাপ করছিস, মা!
একবার কইছিলাম তোরে
কেন এতো বিষন্ন লাগে উত্তর আসমান
দুপুরে পাখিগো সুর ছিঁড়া ছিড়া পড়ে আমড়াগাছের
হলদে পাতার উপর, পায়ের নীচে মাটিকে মনে হয়
বরফের উপর খাড়াইয়া আছি চুপচাপ
একটা ঠান্ডা সাপ ভেতর ঢুকে তরপায় খুব।
কেন এতো কষ্ট লাগে শ্বাস নিতে অন্দরমহলে।
নিশুতি রাত্রে কে জানি ডাক দিছিল নিঃসঙ্গ জানলার পাশে
মনে হইলো কেউ জরায়ুর ভেতর থিকা চিৎকর
পারতাছে।
ওই রাত্রে কোন বৃক্ষ নেয় নাই কাছে
কোন জল কই নাই পায়ে পায়ে হাঁটি
শ্মশানের পোড়া বাতাস বহে নাই শনশন কইরা
আমারে নিছিল সেই চিৎকর নাড়িতে টান দিয়া
তোর জরায়ুতে শনিবার।
একটা দড়ি দিয়া বান্ধা ছিলাম তোর জঠরে।
মনে ইচ্ছে হয়, ওই পাঁজরে সেই দড়িখান বাইন্ধা
ঝুইলা পড়ি পেটের ভিত্রে।
🥰🥰
উত্তরমুছুনঅনবদ্য! কবির আত্মহত্যার পথ আরও ব্যথাতুর হোক!
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন